আল কুরআন সংকলন ও সংরক্ষণের বিস্তারিত ইতিহাস
আল কুরআন সংকলন ও সংরক্ষণের বিস্তারিত ইতিহাস
ড. যুবাইর মুহাম্মাদ এহসানুল হক
এ প্রসঙ্গে আমরা ড. যুবাইর মুহাম্মাদ এহসানুল হক এর 'আমীরুল মুমিনীন উসমান ইবনু আফফান রাদিআল্লাহু 'আনহু' গ্রন্থ থেকে কুরআন সংকলনের ইতিহাস উল্লেখ করছি।
‘উসমান (রা.) এর জীবনের সবচাইতে মূল্যবান কীর্তি হল কুরআন সংকলন। মনে রাখা আবশ্যক, আবূ বাকর (রা.) এর সময়ে সর্বপ্রথম কুরআন সংকলন করা হয়। তবে সর্বসাধারণের উপলব্ধির সুবিধার্থে এই পরিভাষা চালু হয়েছে যে, “উসমান (রা.) কুরআনের সংকলক”। আসলে ব্যাপারটি তেমন নয়। উসমান (রা.) প্রথমবারের মতো কুরআন সংকলন করেননি; তিনি বরং সমগ্র মুসলিম উম্মাহকে এক হরফ বা এক ‘কিরাআত'-এর ওপর একত্র করেছিলেন বা একই ধরনের কিরাআত পদ্ধতির ওপর ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন। কোন প্রেক্ষাপটে উসমান (রা.)-কে এক কিরাআতের ভিত্তিতে আল কুরআন একত্র করতে হয়েছিল আমরা তা আলোচনা করব। অবশ্য তৎপূর্বে আল কুরআন সংকলনের পূর্ববর্তী ইতিহাস সম্পর্কে আলোকপাত করা দরকার।
কুরআন সংকলনের পর্যায়সমূহ
প্রথম পর্যায়:
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) -এর যুগ:
অকাট্য দলীল দ্বারা এ কথা প্রমাণিত যে, যখনই আল কুরআনের কোন অংশ নাযিল হত তখনই রাসূলুল্লাহ(ﷺ) তা লিখিয়ে রাখতেন। কয়েকজন সাহাবী ওয়াহী লেখার দায়িত্বে নিযুক্ত ছিলেন। এঁদেরকে কাতিবুল ওয়াহী' বলা হয়। ওয়াহী লেখার ক্ষেত্রে বিশিষ্টতা অর্জন করায় যায়িদ ইবনু সাবিত (রা.) ‘কাতিবুন নাবী’ অভিধায় ভূষিত হয়েছিলেন। ইমাম বুখারী(র.) ফাদাইলুল কুরআন অধ্যায়ে ‘কাতিবুন নাবী' নামে একটি অনুচ্ছেদের শিরোনাম নির্ধারণ করেছেন এবং এর অধীনে দুটো হাদীস উল্লেখ করেছেন:
প্রথম হাদীসঃ আবূ বাকর (রা.), যায়িদ ইবনু সাবিত (রা.)-কে বলেছেন,.. তুমি তো রাসূলুল্লাহর(ﷺ) নির্দেশে ওয়াহী লিপিবদ্ধ করতে.. ( সহীহুল বুখারী, কিতাবু ফাদাইলিল কুরআন, বাবু কাতিবিন নাবী, ২:৬৪৫)
দ্বিতীয় হাদীস: যখন সূরা আন্ নিসার ৯৫ নং আয়াত নাযিল হল তখন রাসূলুল্লাহ(ﷺ) বললেন, 'যায়িদকে ডাকো, সে যেন ফলক, দোয়াত ও হাড় নিয়ে আসে..(প্রাগুক্ত, ২:৬৪৬)
মাক্কী জীবনেও রাসূলুল্লাহ(ﷺ) ওয়াহী লিখানোর ব্যবস্থা করতেন। মাক্কার ওয়াহী লেখকদের অন্যতম ছিলেন আবদুল্লাহ ইবনু সা'দ ইবনু আবি সারহ; অবশ্য তিনি মুরতাদ হয়ে যান, পরবর্তীতে মাক্কা বিজয়ের দিন পুনরায় ইসলাম গ্রহণ করেন। চার খালীফাও ওয়াহী লিখতেন। সম্ভবত তাঁরা মাক্কী জীবনে ওয়াহী লিখতেন। মাক্কী জীবনে ওয়াহী লিপিবদ্ধ করার একটি প্রমাণ হল এই যে, ইসলাম গ্রহণের দিন ‘উমার (রা.) সূরা তা-হা’র আয়াতগুলো তার বোনের কাছে পুস্তিকা আকারে লিপিবদ্ধ অবস্থায় পেয়েছিলেন। সূরা আল বায়্যিনাহ-এ আল্লাহ তা'আলা ঘোষণা দিয়েছেন যে, রাসূলুল্লাহ(ﷺ) গ্রন্থাকারে লিপিবদ্ধ আল কুরআন আবৃত্তি করেন:
رَسُولٌ مِّنَ اللَّهِ يَتْلُو صُحُفًا مُّطَهَّرَةً
আল্লাহর নিকট হতে প্রেরিত এক রাসূল, যে আবৃত্তি করে পবিত্র পুস্তিকাসমূহ
[আল কুরআন ৯৮:২]।
মাক্কী ও মাদানী জীবনে আরো যারা ওয়াহী লিখতেন তাঁদের মধ্যে ছিলেনঃ আয যুবাইর ইবনুল আওয়াম (রা.), খালিদ ইবনু সাঈদ ইবনিল ‘আস (রা.), আবান ইবনু সাঈদ ইবনিল ‘আস (রা.), হানযালাহ ইবনুর রাবী' আল আসাদী (রা.), মু'আইকীব ইবনু আবি ফাতিমা (রা.), আবদুল্লাহ্ ইবনুল আরকাম (রা.), শুরাহবীল ইবনু হাসানাহ (রা.), ‘আবদুল্লাহ্ ইবনু রাওয়াহা (রা.), মু'আবিয়া ইবনু আবি সুফইয়ান (রা.), উবাই ইবনু কা'ব (রা.), খালিদ ইবনুল ওয়ালীদ (রা.) ও সাবিত ইবনু কায়স (রা.) প্রমুখ। (ইবনু হাজার, ফাতহ.., ৮:৬৮৩; সুবহী আস-সালিহ, মাবাহিস ফী উলুমিল কুরআন (বৈরুতঃ দারুল ‘ইলম লিল মালাঈন ১৯৯৯), ৬৯)
রাসূলুল্লাহ(ﷺ)-এর নির্দেশনা অনুসারে কাতিবগণ বিভিন্ন সূরার আওতায় আয়াতগুলোকে বিন্যস্ত করতেন। তিনি জিবরীল (আ.)-এর নির্দেশনার ভিত্তিতেই আয়াতের ধারাবাহিকতা নির্ধারণ করতেন। উসমান ইবনু আবিল 'আস (রা.) বলেন, “আমি রাসূলুল্লাহ(ﷺ)-এর কাছে উপবিষ্ট ছিলাম; হঠাৎ তিনি চোখ তুলে ওপরের দিকে তাকালেন, কিছুক্ষণ পর চোখ নামিয়ে বললেন, “আমার কাছে জিব্রীল (আ.) এসেছিলেন, তিনি নির্দেশ দিলেন এই আয়াত যেন এই সূরার এই জায়গায় স্থাপন করি।” (সুবহী আস-সালিহ, ৭০) সকল তথ্যাভিজ্ঞ ‘আলিম এ ব্যাপারে একমত যে বিভিন্ন সূরার আওতায় আয়াতগুলোর ধারাবাহিকতা ওয়াহীর নির্দেশনার আলোকে সম্পন্ন হয়েছে। তাই এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে, বর্তমানে আয়াতগুলো যেভাবে বিন্যস্ত রয়েছে রাসূলুল্লাহ(ﷺ)-এর যুগেও ঠিক সেভাবেই বিন্যস্ত ছিল। সংখ্যাগরিষ্ঠ ‘আলিমগণের মতে সূরাগুলোর ধারাবাহিকতাও রাসূলুল্লাহ্(ﷺ)-এর নির্দেশনার আলোকে বিন্যস্ত করা হয়েছে। [প্রাগুক্ত, ৭১]
কাতিবগণ রাসূলুল্লাহ(ﷺ)-এর নির্দেশে কুরআন লিপিবদ্ধ করতেন। এটিকে সরকারী ব্যবস্থাপনা বলা যায়। অনেক কাতিব সরকারী অনুলিপির পাশাপাশি নিজেদের জন্য পৃথক অনুলিপি তৈরি করতেন। কাতিব ব্যতীত অন্যান্য সাহাবীগণও নিজেদের পঠন-পাঠনের সুবিধার্থে কুরআনের অনুলিপি প্রস্তুত করতেন। এটি খুবই স্বাভাবিক যে, ব্যক্তিগত অনুলিপিগুলো পুরো আল কুরআন ধারণ করত না।
বস্তুতঃ রাসূলুল্লাহ(ﷺ)-এর মৃত্যুর পূর্বেই পুরো আল কুরআন লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল; তবে তা একত্রিত অবস্থায় ছিল না। আল কুরআন লিপিবদ্ধ ছিল খেজুরের ডাল, হাড়, কাঠফলক, চামড়া ও স্বচ্ছ পাথরে। তৎকালে এগুলোই ছিল লিখন উপকরণ । তাছাড়া বহু হাফিযের স্মৃতিতে পুরো আল কুরআন সংরক্ষিত ছিল। জিবরীল (আ.) প্রতি বছর একবার করে রাসূলুল্লাহ(ﷺ)-এর কাছে আল কুরআন পেশ করতেন। রাসূলুল্লাহ(ﷺ)-এর মৃত্যুর বছর তিনি দু'বার আল কুরআন উপস্থাপন করেছিলেন। আল কুরআনের কোন আয়াত বা বিধান রহিত হওয়ার সম্ভাবনা ছিল বলেই সম্ভবত রাসূলুল্লাহ(ﷺ) তাঁর জীবদ্দশায় আল কুরআন এক জায়গায় একত্র করেননি। তাঁর মৃত্যুর মাধ্যমে আয়াত রহিত হওয়ার সম্ভাবনা চিরতরে বিলীন হওয়ায় আল কুরআন সংকলনে আর কোন বাধা রইল না। - [সুবহী আস-সালিহ, ৭৩ ]
দ্বিতীয় পর্যায়ঃ
আবূ বাকর (রা.)-এর আমল:
আবূ বাকর (রা.)-এর আমলে আল কুরআন সংকলন সম্পর্কে কাতিবুল ওয়াহী যায়িদ ইবনু সাবিত (রা.) বলেন:
ইয়ামামার যুদ্ধের সময় আবূ বাকর (রা.) আমাকে ডেকে পাঠালেন। আমি এসে দেখলাম তাঁর কাছে উমার (রা.) উপস্থিত। আবূ বাকর (রা.) বললেন, ‘উমার (রা.) আমার কাছে এসে বলল, ইয়ামামার যুদ্ধে বিপুল সংখ্যক হাফিযুল কুরআন শহীদ হয়েছেন। আমার আশঙ্কা হয় বিভিন্ন যুদ্ধের ময়দানে বিপুল সংখ্যক হাফিযুল কুরআনের শাহাদাতে আল কুরআনের বিরাট অংশ হারিয়ে যাবে। আমার অভিমত হচ্ছে আপনি কুরআন একত্রকরণের নির্দেশ দিন।' আমি (আবূ বাকর) ‘উমার (রা.)-কে বললাম, রাসূলুল্লাহ(ﷺ) যে কাজ করেননি আমি তা কিভাবে করব?' জবাবে উমার (রা.) বললেন, 'আল্লাহর শপথ, এটি কল্যাণকর হবে।’ এরপর উমার (রা.) বারংবার পীড়াপীড়ি করতে লাগলেন, এমনকি আল্লাহ ঐ কাজ করার ব্যাপারে আমার অন্তর প্রশস্ত করে দিলেন যে ব্যাপারে ইতোপূর্বে উমার (রা.)-এর অন্তর প্রশস্ত করেছেন। যায়িদ (রা.) বলেন, অতঃপর আবূ বাকর (রা.) বললেন, নিশ্চয় তুমি বুদ্ধিমান যুবক, তোমার সম্পর্কে কোন অভিযোগও নেই। তুমি রাসূলুল্লাহ(ﷺ)-এর আমলে ওয়াহী লিপিবদ্ধ করতে। সুতরাং এবারও অনুসন্ধান চালিয়ে কুরআন সংকলন কর!
যায়িদ (রা.) আরো বলেন:
আল্লাহর শপথ! তাঁরা যদি আমার ওপর কোন পাহাড় স্থানান্তরের দায়িত্ব চাপাতো তাও আমার কাছে এতটা দুর্বহ মনে হত না যতটা মনে হয়েছে কুরআন সংকলনের দায়িত্ব। আমি খেজুরের ডাল, পাথর ও হাড় এবং হাফিযদের স্মৃতির সঞ্চয় হতে কুরআন সংকলন করলাম। সূরা আত তাওবার শেষ দু'টো আয়াত পেলাম আবূ খুযাইমা আল আনসারীর নিকট। একত্রিত ও সংকলিত কুরআনের কপি আবূ বাকর (রা.)-এর জীবদ্দশায় তাঁরই কাছে ছিল। তাঁর মৃত্যুর পর ‘উমার (রা.)-এর কাছে ছিল। উমার (রা.)-এর মৃত্যুর পর তা ছিল তদীয় কন্যা উম্মুল মু'মিনীন হাফসা (রা.)-এর নিকট। [সহীহুল বুখারী, কিতাবু ফাদাইলিল কুরআন, বাবু জাম’ইল কুরআন, ২:৬৪৪-৪৫; সহীহুল বুখারী, কিতাবুল আহকাম, ৩:৪৯৫-৯৬ ]
যায়িদ ইবনু সাবিত (রা.)-এর উক্তির আলোকে আবূ বাকর (রা.)-এর আমলে কুরআন সংকলন
ক. আবূ বাকর (রা.)-এর আমলে কুরআন সংকলনের কারণঃ
আবূ বাকর (রা.)এর আমলে কুরআন সংকলনের কারণ এটি ছিল না যে কুরআন লিপিবদ্ধ ছিল না। ইতিপূর্বে দলীলসহ উল্লেখিত হয়েছে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) পুরো কুরআন লিপিবদ্ধ করার ব্যবস্থা করেছিলেন; তবে লিখিত অংশগুলো একত্রিত অবস্থায় ছিল না । আবূ বাকর (রা.)-এর আমলে আরবের অনেকগুলো গোত্র ইসলাম ত্যাগ করে মুরতাদ হয়ে যায়, অনেকে যাকাত প্রদানে অস্বীকৃতি জানায়, কেউ কেউ মিথ্যা নুবুওয়াত দাবি করে। ভণ্ড নাবীদের মাঝে সবচাইতে শক্তিশালী ছিল মুসাইলামাহ্ আল কায্যাব। আবূ বাকর (রা.) তার বাহিনীর বিরুদ্ধে খালিদ ইবনুল ওয়ালীদের(রা.) নের্তৃত্বে বিরাট বাহিনী প্রেরণ করেন। ইয়ামামার প্রচণ্ড যুদ্ধে মুসাইলামাহ্ পরাজিত ও নিহত হয়। তবে এই যুদ্ধে মুসলিমদের বিপুল প্রাণহানি হয়; কোন কোন বর্ণনা মতে সাত শতাধিক সাহাবী শহীদ হন যাঁদের অনেকে হাফিযুল কুরআন ছিলেন। [ইবনু হাজার, ফাতহ, ৮:৬৭১-৭২]চারজন সাহাবীর কাছ থেকে রাসূলুল্লাহ(ﷺ) কুরআন তিলাওয়াত শেখার নির্দেশ দিয়েছিলেন, সালিম (রা.) ছিলেন তাঁদের একজন।[সাহীহুল বুখারী, কিতাবু ফাদাইলিল কুরআন, বাবুল কুররা মিন আসহাবিন নাবী(ﷺ), ২:৬৪৮ ] ইয়ামামার যুদ্ধে সালিমও (রা.) শহীদ হন।[আয-যাহাবী, তারীখ,, ৩:২৭৮]
বিপুল সংখ্যক হাফিয সাহাবী বিশেষত সালিম (রা.)-এর মত অবিসংবাদিত কারীর মৃত্যুতে ‘উমার (রা.) যারপরনাই আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। তাঁর আশঙ্কা ছিল এই যে, হাফিয ও কারীগণের তিরোধানে কুরআনের কোন অংশ বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে। তাই তিনি আবূ বাকর (রা.)-কে কুরআন একত্রীকরণ ও সংকলনের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরোধ করেন। প্রথমে আবূ বাকর (রা.) ইতস্তত করেন এই কারণে যে, রাসূলুল্লাহ(ﷺ) যা করেননি তা তিনি করতে চান না।[কুরআন সংকলনের মাধ্যমে আবূ বাকর (রা.) অভিনব কোন কাজ করেননি। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কুরআন লিপিবদ্ধ করেছিলেন; আবূ বাকর তাই করেছেন, তবে তিনি বিক্ষিপ্ত অংশগুলো একত্রে গেঁথেছেন। ] অবশ্য পরে আল্লাহ কুরআন সংকলনের পক্ষে তাঁর অন্তর প্রশস্ত করে দেন এবং তিনি উম্মাহর জন্য অত্যন্ত উপকারী পদক্ষেপটি গ্রহণ করেন।
খ. কুরআন সংকলনের দায়িত্ব অর্পিত হয় কাতিবুল ওয়াহী যায়িদ (রা.)-এর ওপরঃ
আবূ বাকর (রা.) কুরআন একত্রীকরণ ও সংকলনের এই গুরু দায়িত্ব অর্পণ করেন কাতিবুল ওয়াহী যায়িদ ইবনু সাবিত (রা.)-এর ওপর। এই গুরু দায়িত্ব আঞ্জাম দেয়ার জন্য যায়িদ (রা.)-কে কেন বাছাই করলেন আবূ বাকর (রা.) তাও পরিষ্কার করলেন তাঁর বক্তব্যে: “নিশ্চয় তুমি বুদ্ধিমান যুবক, তোমার সম্পর্কে কোন অভিযোগও নেই। তুমি রাসূলুল্লাহ(ﷺ)-এর আমলে ওয়াহী লিপিবদ্ধ করতে।” এই উক্তি হতে যায়িদ (রা.)-এর উপযুক্ততার কারণগুলো পাওয়া যায়:
১. যায়িদ বয়সে তরুণ ছিলেন, তাঁর বয়স ছিল মাত্র একুশ; স্বভাবতই দায়িত্ব আনঞ্জাম দেয়ার ক্ষেত্রে তিনি তৎপর হবেন, এটি আশা করা যায়।
২. তিনি অধিক উপযুক্ত ছিলেন, যাঁকে আল্লাহ অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত জ্ঞান-বুদ্ধি দিয়েছেন কল্যাণের পথ তাঁর জন্য সহজ হবে।
৩. যায়িদ (রা.) আস্থাভাজন ছিলেন, তাঁর ব্যাপারে কোন অভিযোগ ছিল না। সুতরাং এটা ধরে নেওয়াই স্বাভাবিক যে তাঁর দায়িত্বে সম্পাদিত কাজ গ্রহণযোগ্য হবে।
৪. তিনি রাসূলুল্লাহ(ﷺ)-এর কাতিবুল ওয়াহী ছিলেন; সুতরাং এই কাজে তাঁর পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল, এই কাজ তাঁর কাছে নতুন কিছু নয়।
গ. আল কুরআন সংকলনে যায়িদ (রা.)-এর কর্মধারা:
আবূ বাকর (রা.), যায়িদ (রা.)-কে কুরআন সংকলনের পদ্ধতি সম্পর্কেও নির্দেশনা প্রদান করেন। তিনি উমার (রা.) ও যায়িদ (রা.)-কে বলেন, “তোমরা দু'জন মাসজিদের দরজায় বসো, কেউ আল্লাহর কিতাবের কোন অংশ দু'জন সাক্ষীসহ নিয়ে আসলে তোমরা তা লিপিবদ্ধ করবে।”[আস-সুয়ূতী, আল-ইতকান (কায়রো: মাতবা'আ হিজাযী ১৯৪১), ১:১০০] এই নির্দেশনার আলোকে যায়িদ ইবনু সাবিত (রা.) পুরো এক বছরের প্রচেষ্টায় আল কুরআন একত্রকরণ ও সংকলনের কাজ সমাপ্ত করেন। যায়িদ (রা.)-এর সংকলন পদ্ধতি এই ছিল যে, তিনি তখনই একটি আয়াত গ্রহণ করতেন যখন কেউ দাবি করত এটি সে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সামনে লিপিবদ্ধ করেছে। আবার শুধু মুখস্থ শক্তির ওপর নির্ভর করতেন না। লিখিত রূপের সাথে হাফিযদের স্মৃতিতে সংরক্ষিত আয়াত মিলিয়ে নিতেন। কমপক্ষে দু'জনের কাছে লিখিত অবস্থায় পাওয়া গেলেই কেবল সেই আয়াত গ্রহণ করা হত। কেউ এটা দাবি করলেই যায়িদ গ্রহণ করতেন না যে এটি কুরআনের আয়াত; বরং তার সাথে দু'জন সাক্ষীর প্রয়াোজন হতো, যারা সাক্ষ্য দেবে যে এই অংশটি রাসূলুল্লাহ(ﷺ)-এর সামনে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। এভাবেই সতর্ক পদক্ষেপে ও সুচারু অনুসন্ধানে যায়িদ (রা.) কুরআন সংকলনের কাজ সম্পন্ন করেন। সূরা আত তাওবার শেষ দুটো আয়াত তিনি শুধু আবূ খুযাইমাহ্ আল-আনসারী (রা.)-এর কাছে লিখিত অবস্থায় পান। এই অংশটি দ্বিতীয় কারো কাছে লিখিত না পাওয়া গেলেও যায়িদ (রা.) এটি গ্রহণ করেন। কারণ প্রকারান্তরে এই দুই আয়াতের পক্ষে দু'ধরনের সাক্ষী ছিল: হিফয ও লিখন। আয়াত দুটি যায়িদসহ অনেক সাহাবীর স্মৃতিতে সংরক্ষিত ছিল, অবশ্য লিখিত অবস্থায় ছিল শুধু এক জনের কাছে। অতএব এই দু'টি যে কুরআনের অংশ সে বিষয়ে কোন সংশয় ছিল না।
ঘ. রাসূলুল্লাহ (ﷺ) -এর লিখন ও আবূ বাকর (রা.)-এর লিখনের মধ্যে পার্থক্য:
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ(ﷺ)-এর আমলে পুরো কুরআন লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল। তৎকালে লিখন সামগ্রী হিসেবে যা ব্যবহৃত হত যথা ফলক, খেজুর ডাল, হাড়, পাথর প্রভৃতির ওপর কুরআন লিপিবদ্ধ করা হত। তবে কুরআনের সূরাগুলো ধারাবাহিকভাবে বিন্যস্ত এবং এক জায়গায় সংরক্ষিত ছিল না। আবূ বাকর (রা.)-এর আমলে সূরাগুলো ধারাবাহিকভাবে বিন্যস্ত করে একত্র করা হয়। বিন্যস্ত করার ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ(ﷺ)-এর নির্দেশনা অনুসরণ করা হয়।
সমগ্র মুসলিম উম্মাহ এই বিষয়ে একমত যে আবূ বাকর (রা.)-এর আমলে সংকলিত কুরআন হল সেটি যা জিবরীল (আ.), রাসূলুল্লাহ(ﷺ)-এর কাছে তাঁর জীবনের শেষ বছরে উপস্থাপন করেছিলেন। আবূ বাকর (রা.) এর মৃত্যুর পর কুরআনের কপিটি উমার (রা.)-এর কাছে রক্ষিত ছিল। তিনি আহত হয়ে মৃত্যুশয্যায় পতিত হলে আল কুরআনের কপিটি উম্মুল মু'মিনীন হাফসা (রা.)-এর নিকট গচ্ছিত রাখেন। কারণ তিনি কোন স্থলাভিষিক্ত নিযুক্ত করেননি। বরং ছয় সদস্য বিশিষ্ট নির্বাচক পরিষদের হাতে পরবর্তী খালীফা নিয়োগের দায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন।
তৃতীয় পর্যায়: ‘উসমান (রা.)-এর আমলে কুরআন সংকলনঃ
ক. উসমান (রা.)-এর আমলে কুরআন সংকলনের হেতু:
বিশিষ্ট সাহাবী হুযাইফা ইবনুল ইয়ামান (রা.) উসমান (রা.)-এর আমলে সিরিয় ও ইরাকী যোদ্ধাদের সাথে আর্মেনিয়া ও আজারবাইজান বিজয়াভিযানে অংশগ্রহণ করেছিলেন। নানা অঞ্চলের মানুষের কুরআন পাঠের ভিন্নতা দেখে তিনি শঙ্কিত হয়ে পড়লেন। তিনি পর্যবেক্ষণ করলেন, কেউ ইবনু মাসউদ (রা.)-এর অনুসরণে কুরআন তিলাওয়াত করে, আবার অন্যরা আবূ মূসা আল-আশ'আরীর (রা.) কিরাআত তিলাওয়াত করে। শুধু তাই নয়, এক দল অন্য দলকে হেয়জ্ঞান করে। এই অবস্থা দেখে তিনি বললেন, “কূফাবাসী বলে: ইবনু মাসউদের কিরাআত, বাসরাবাসী বলে: আবূ মূসার কিরাআত। আল্লাহর শপথ! আমি আমীরুল মু'মিনীনের কাছে গিয়ে অনুরোধ করব তিনি যেন সবাইকে একই পঠনপদ্ধতির ওপর একত্রিত করেন।” অভিযান শেষে মাদীনায় এসে হুযাইফা (রা.) উসমান (রা.)-কে বললেন, “আমীরুল মু'মিনীন! ইয়াহুদী ও নাসারাদের মত নিজেদের কিতাবের ব্যাপারে মতভেদ করার পূর্বেই আপনি এই উম্মাহকে সামলান।”[ইবনু হাজার, ফাতহ, ৮:৬৭৮ ]
পঠনপদ্ধতির ভিন্নতার কারণে বিভিন্ন কারীর ছাত্রদের মাঝে বচসার বিষয়টি উসমান (রা.) মাদীনায়ও প্রত্যক্ষ করেছিলেন। একবার তিনি মাসজিদে খুতবা দিতে গিয়ে বলেছিলেন, “তোমরা আমার সামনেই মতভেদ কর, না জানি দূরে যারা আছে তারা কী করে?”[প্রাগুক্ত, ৮:৬৭৯ ]
খ: কুরআন সংকলনের বিষয়ে সাহাবীদের সাথে উসমান (রা.)-এর পরামর্শ:
হুযাইফা ইবনুল ইয়ামান (রা.)-এর আরজটি উসমান (রা.) অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে নিলেন। করণীয় নির্ধারণে তিনি মুহাজির ও আনসারী সাহাবীগণকে একত্রিত করলেন; উম্মাহ-এর শ্রেষ্ঠ ‘আলিম, ফকীহ ও বিজ্ঞ ব্যক্তি এঁদের মাঝেই ছিলেন, যাদের শীর্ষে ছিলেন ‘আলী ইবনু আবি তালিব (রা.)। তাঁরা দীর্ঘ সময় ধরে আলোচনা-পর্যালোচনা শেষে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন যে, এই অবস্থা দীর্ঘায়িত হতে দেয়া যায় না, মুমিনদের অন্তরে কোন প্রকার সন্দেহ-সংশয় যেন প্রবেশ না করতে পারে। তাঁরা হাফসা (রা.)-এর কাছে রক্ষিত সাহীফাগুলো হতে অনুলিপি প্রস্তুত করে কুরআনের বিশুদ্ধ কপি ইসলামী খিলাফাতের নানা স্থানে প্রেরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
সিদ্ধান্ত অনুসারে খালীফা, উম্মুল মু'মিনীন হাফসা (রা.)-এর কাছে দূত পাঠিয়ে বললেন, “আমার কাছে কুরআনের অংশগুলো পাঠিয়ে দিন, আমি কয়েকটি অনুলিপি তৈরী করে মূল কপিগুলো আপনার কাছে ফেরত পাঠাবো।” হাফসা (রা.) তাঁর কাছে রক্ষিত আল কুরআনের সাহীফাগুলো উসমান (রা.)-এর কাছে পাঠিয়ে দেন।
গ. কুরআন সংকলনের জন্য চার সদস্যের কমিটি গঠন:
উসমান (রা.) চার সদস্যের একটি কমিটি গঠন করলেন, যার সদস্যরা ছিলেন: যায়িদ ইবনু সাবিত (রা.), 'আবদুল্লাহ ইবনুয যুবাইর (রা.), সা'ঈদ ইবনুল আস (রা.) ও ‘আবদুর রহমান ইবনুল হারিস ইবনি হিশাম (রা.)। তাদেরকে আবূ বাকর (রা.)-এর সাহীফাগুলোর আলোকে কুরআনের অনুলিপি প্রস্তুত করার নির্দেশ দিলেন। কমিটির সদস্যদের মাঝে যায়িদ (রা.) ছিলেন আনসারী, বাকি তিনজন ছিলেন কুরাইশী। তিনজনের কুরাইশ দলকে ‘উসমান (রা.) বললেন,
إذا اختلفتم أنتم وزيد بن ثابت في شيء من القرآن فاكتبوه بلسان قريش فإنما نزل بلسانهم
কুরআনের কোন শব্দের আরবীত্বের ব্যাপারে যায়িদ ইবনু সাবিত (রা.)-এর সাথে তোমাদের মতভেদ হলে তোমরা তা কুরাইশী ভাষায় লিপিবদ্ধ কর; কারণ এই কিতাব তাদের ভাষায় নাযিল হয়েছে।”[সাহীহুল বুখারী, কিতাবু ফাদাইলিল কুরআন, বাবু জাম’ইল কুরআন, ২:৬৪৫ ]
২৫ হিজরীতে কমিটির সদস্যরা কাজ শুরু করেন। চার সদস্যের কমিটির সবাই হাফিযুল কুরআন হলেও তাঁরা হাফসার (রা.) কাছ থেকে আনীত সাহীফাগুলোর ওপর ভিত্তি করে কুরআনের কয়েকটি অনুলিপি প্রস্তুত করলেন। উসমান (রা.) কোন কোন শব্দের আরবীত্বের ব্যাপারে মতভেদের আশঙ্কা করেছিলেন; তবে একটি মাত্র শব্দ নিয়ে যায়িদ (রা.) ও কুরাইশী সংকলকদের মাঝে কোন বিষয়ে মতভেদ হয়েছিলো বলে জানা যায়। শব্দটি হল ‘তাবূত’ (التابوت) মাদীনার আনসারদের উপভাষায় এটির পাঠ ছিল ‘তাবূহ’ (التابوه)। এ বিষয়ে উসমান (রা.)-এর কাছে নির্দেশনা চাওয়া হলে তিনি ‘তাবূত’ লিখতে বলেন[ইবনু হাজার, ফাতহ, ৮:৬৮০-৮১ ]
‘উসমান (রা.)-এর আমলে সংকলিত আল কুরআনে আয়াত বা সূরার ধারাবাহিকতা রক্ষার ক্ষেত্রে কোনরূপ পরিবর্তন আনা হয়নি। আবূ বাকর (রা.)-এর সংকলনে যে ধারাবাহিকতা ছিল সেটিই হুবহু বহাল ছিল উসমান (রা.)-এর সংকলনে। তাছাড়া কোন শব্দে কোনরূপ পরিবর্তন আনা হয়নি, সেটি সম্ভবও ছিল না। কুরআন সংকলনকালে ইবনু যুবাইর (রা.), উসমান (রা.)-কে বলেছিলেন, 'সুরা আল বাকারার ২৪০ নং আয়াতটি তো অন্য আয়াত দ্বারা (একই সূরার ২৩৪ নং আয়াত দ্বারা) মানসূখ হয়ে গেছে, তবে কেন আপনি সেটি বহাল রাখছেন?[সূরাতুল বাকারার ২৪০নং আয়াতটির অনুবাদ নিম্নরূপ: “তোমাদের মধ্যে যাদের মৃত্যু আসন্ন এবং স্ত্রী রেখে যায় তারা যেন তাদের স্ত্রীদেরকে গৃহ হতে বহিষ্কার না করে তাদের এক বছরের ভরণপোষণের ওয়াসীয়াত করে। কিন্তু যদি তারা বেরিয়ে যায় তবে বিধিমত নিজেদের জন্য যা করবে তাতে তাদের কোন গুনাহ নেই। আল্লাহ্ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।” (আল কুরআন ২:২৪০]। এই আয়াতের বিধান অনুসারে স্বামীগতা নারীদের ইদ্দত হিল এক বছর, এই সময় তাদের ভরণ-পোষণ স্বামীর সম্পদ হতে নির্বাহ করা হত। এই আয়াতের বিধান একই সূরার ২৩৪ নং আয়াত দ্বারা রহিত হয়ে গেছে। সূরাতুল বাকারার ২৩৪ নং আয়াতটির অনুবাদ নিম্নরূপ: “তোমাদের মধ্যে যারা স্ত্রী রেখে মৃত্যুমুখে পতিত হয় তাদের স্ত্রীগণ চার মাস দশ দিন প্রতীক্ষা করবে। (আল কুরআন ২:২৩৪]। এই আয়াত দ্বারা পূর্বোক্ত ২৪০নং আয়াতের বিধান রহিত হয়ে গেছে। বর্তমানে স্বামীগতা স্ত্রীরা চার মাস দশ দিন ইদ্দত পালন করবে (যদি গর্ভবতী না হয়)। ]জবাবে ‘উসমান (রা.) বললেন,
یا ابن أخي لا أغير شيئا من مكانه
ভাতিজা, আমি (আল কুরআনের) কোন কিছু স্বস্থান হতে পরিবর্তন করতে পারি না।”[সাহীহুল বুখারী, কিতাব তাফসীরিল কুরআন, ২:৪৬৮ ]
খালীফার এই জবাব হতে বুঝা যায়, কোন আয়াত বাদ দেয়া তো দূরের কথা, কোন আয়াতের স্থান পর্যন্ত পরিবর্তন করা হয়নি। মৃত্যুর পূর্বে রাসূলুল্লাহ(ﷺ)-এর সামনে জিবরীল (রা.) পুরো কুরআন উপস্থাপন করেছিলেন। আবূ বাকর (রা.)-এর সংকলনটি সেই উপস্থাপনার অনুরূপ, আবার ‘উসমান (রা.)-এর সংকলনটি ছিল আবূ বাকর (রা.)-এর সংকলনের অনুরূপ। এখানে কোনরূপ পরিবর্তন-পরিবর্ধনের কোন ক্ষমতা কারো ছিল না।
ঘ. বিভিন্ন প্রদেশে কারী ও কুরআনের কপি প্রেরণঃ
গ্রন্থাকারে কুরআনের অনুলিপি তৈরির কাজ সম্পন্ন হলে ‘উসমান (রা.) মূল কপির পৃষ্ঠাগুলো হাফসা (রা.)-এর কাছে ফেরত পাঠালেন এবং অনুলিপিকৃত কুরআনের এক একটি কপি দূরবর্তী অঞ্চলগুলোতে প্রেরণ করলেন। এই কপিগুলোতে হারাকাত বা স্বরচিহ্ন এবং নুক্তা ছিল না। ফলে কুরআনের শব্দগুলো বিভিন্নভাবে তিলাওয়াত করার সুযোগ ছিল। এ কারণে উসমান (রা.) কুরআনের অনুলিপি প্রেরণের পাশাপাশি কারীও প্রেরণ করেন, যাতে তারা জনগণকে একই পদ্ধতির কিরাআতের প্রশিক্ষণ দিতে পারেন।
উসমান (রা.) বিভিন্ন শহরে আল কুরআনের কয়টি কপি পাঠিয়েছিলেন?
বিভিন্ন প্রদেশে প্রেরিত মুসহাফের (কুরআনের কপি) সংখ্যার বিষয়ে মতভেদ আছে। অধিকাংশ ‘আলিম বলেন, 'উসমান (রা.) চারটি মুসহাফ প্রস্তুত করেছিলেন। মাদীনায় একটি মুসহাফ রেখে বাকিগুলো সিরিয়া, কূফা ও বাসরায় পাঠানো হয়েছিল। কেউ কেউ বলেন, উপযুক্ত চারটির পাশাপাশি কুরআনের আরেকটি কপি মাক্কাবাসীদের জন্য প্রেরণ করা হয়েছিল। আবার কারো মতে, প্রেরিত মুসহাফের সংখ্যা ছয়; পূর্বোক্ত পাঁচটি এবং আরেকটি পাঠিয়েছিলেন বাহরাইনে। যাঁরা বলেন, সাতটি মুসহাফ প্রেরণ করা হয়েছিল তাঁরা বলেন সপ্তম কপিটি ইয়ামানে পাঠানো হয়েছিল। প্রেরিত মুসহাফের সংখ্যা আট বলেও একটি মত পাওয়া যায়, সেমতে অষ্টম মুসহাফটি উসমান (রা.) নিজের কাছে রেখেছিলেন। শাহাদাতের সময় তিনি সেটি তিলাওয়াত করছিলেন[আদওয়াউল বায়ান ফী তারীখিল কুরআন, ৭৭ ]প্রতিটি মুসহাফের সাথে একজন করে কারীও প্রেরণ করা হয়, যার দায়িত্ব ছিল বিশুদ্ধ তিলাওয়াত পদ্ধতি প্রশিক্ষণ দেওয়া। আবদুল্লাহ ইবনু সাইব (রা.)-কে মাক্কায়, আল-মুগীরা ইবনু শিহাবকে সিরিয়ায়, আবূ আবদিল্লাহ আস-সুলামীকে কুফায়, ‘আমির ইবনু কায়সকে বাসরায় প্রেরণ করা হয়। যায়িদ ইবনু সাবিত (রা.)-কে মাদীনার অধিবাসীদেরকে কিরাআত প্রশিক্ষণের নির্দেশ দেয়া হয়।[প্রাগুক্ত ]
ঙ. কুরআনের অন্য কপিগুলো জ্বালিয়ে দেওয়ার নির্দেশঃ
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ(ﷺ) সরকারীভাবে কুরআনের প্রতিটি আয়াত লিপিবদ্ধ করার ব্যবস্থা করেছিলেন। পাশাপাশি অনেক সাহাবী ব্যক্তিগত অধ্যয়নের জন্য কুরআনের আয়াত লিপিবদ্ধ করতেন। এই অনুলিপিগুলো পূর্ণাঙ্গ ছিল না। তাছাড়া কুরআনের বাণী উপলব্ধির সুবিধার্থে অনেক সময় সাহাবায়ে কিরাম তাঁদের ব্যক্তিগত অনুলিপিতে আয়াতের পাশাপাশি কোন কোন শব্দের ব্যাখ্যাও লিখে রাখতেন। খালীফা কর্তৃক রাষ্ট্রীয়ভাবে কুরআনের বিশুদ্ধতম ও পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি তৈরি করার পর ব্যক্তিগত কপিগুলো বহাল রাখার উপায় ছিল না। কারণ এতে বিভ্রান্তি ছড়ানোর সুযোগ ছিল। প্রয়োজনে স্টান্ডার্ড কপি হতে অনুলিপি করার সুযোগ ছিল। তাই ‘উসমান (রা.) নির্দেশ দিলেন মাদীনা হতে প্রেরিত মুসহাফ ব্যতীত কুরআনের অন্যান্য কপিগুলো যেন জ্বালিয়ে দেওয়া হয়।[সহীহুল বুখারী, কিতাবু ফাদাইলিল কুরআন, বাবু জাম’ইল কুরআন, ২:৬৪৫ ]ইবনু হাজার আল-আসকালানী উল্লেখ করেছেন যে, কুরআনের কপিগুলো জ্বালিয়ে দেওয়ার পূর্বে পানি দিয়ে ভালোভাবে ধুয়ে ফেলা হয়েছিল[ইবনু হাজার, ফাতহ, ৮:৬৮২] এভাবে আল্লাহর কালাম পাঠে মতভেদ করা হতে মুসলিম উম্মাহ্ পরিত্রাণ লাভ করে।
চ. সাহাবায়ে কিরামের ইজমা':
সাহাবায়ে কিরামের ঐকমত্যের ভিত্তিতে কুরআন সংকলনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। তাঁরা ‘উসমান (রা.)-এর এই সিদ্ধান্তে বিমোহিত হয়ে বলেছিলেন, “আপনার সিদ্ধান্ত কতই না উত্তম”, এবং “তিনি চমৎকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।”[ফিতনাতু মাকতালি উসমান, ১:৭৮ ]
মুসআব ইবনু সা'দ সাহাবায়ে কিরামের যুগ পেয়েছেন। তাঁর মন্তব্য হল এই যে, কুরআন সংকলনে উসমান (রা.)-এর সিদ্ধান্তে তাঁরা মুগ্ধ হয়েছিলেন।[আল-বুখারী, আত-তারীখুস সাগীর, ১:৯৪]কুরআন সংকলনের কারণে যারা উসমান (রা.)-এর সমালোচনা করতো, তাদেরকে ‘আলী (রা.) বলতেন,
يا أيُّها الناس ! لا تغلوا في عثمان، ولا تقولوا له إلا خيراً ـ أو قولوا خيراً ـ فوالله ما فعل الّذي فعل ـ أي في المصاحف ـ إلا عن ملأ منَّا جميعاً؛ أي: الصَّحابة… والله لو ولِّيت؛ لفعلت مثل الّذي فعل.
ওহে জনগণ, উসমান (রা.)-এর ব্যাপারে সীমালঙ্ঘন করো না, তাঁর সম্পর্কে ভাল বৈ অন্য কিছু বলো না। আল্লাহর শপথ, কুরআন সংকলনের ব্যাপারে তিনি তো আমাদের সাথে পরামর্শের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আল্লাহর শপথ, আমি যদি দায়িত্বে থাকতাম তবে অনুরূপ সিদ্ধান্তই নিতাম।[ইবনু হাজার, ফাতহ, ৯:১৮ ]
আল-কুরতুবী (রাহ.) স্বীয় তাফসীরে বলেন, উসমান (রা.) এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন মুহাজির ও আনসারী সাহাবীগণের সাথে পরামর্শ করে। রাসূলুল্লাহ(ﷺ) হতে যা বিশ্বস্ত সূত্রে বর্ণিত তা গ্রহণ এবং অন্যগুলো বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। তাঁরা উসমান (রা.)-এর সিদ্ধান্তকে অনুমোদন করেছিলেন আর এটি ছিল যথার্থ ও সঠিক।[আল-কুরতুবী, আল-জামি' লি আহকামিল কুরআন, ১:৮৮ ]
ছঃ আবূ বাকর (রা.)-এর সংকলন ও ‘উসমান (রা.)-এর সংকলনের মাঝে পার্থক্যঃ
ইবনুত্ তীন (রাহ.) বলেন, আবূ বাকর (রা.)-এর আমলে কুরআন সংকলন করা হয়েছিল এই কারণে যে, তিনি কারীদের তিরোধানে আংশিকভাবে কুরআন বিলুপ্তির আশঙ্কা করেছিলেন; কারণ এই মহাগ্রন্থ এক স্থানে একত্রিত অবস্থায় ছিল না। তিনি রাসূলুল্লাহ(ﷺ)-এর নির্দেশনা অনুসারে সূরাসমূহের আয়াতগুলো ধারাবাহিকভাবে সাজিয়ে কুরআন সংকলন করেন। উসমান (রা.)-এর আমলে কুরআনের পাঠপদ্ধতি নিয়ে মতভেদ দেখা দেয়; আরবী ভাষার বিভিন্ন উপভাষায় কুরআন তিলাওয়াতের সুযোগ থাকায় লোকজন নিজস্ব উপভাষায় কুরআন তিলাওয়াত করত এবং অন্য উপভাষায় তিলাওয়াতকারীদেরকে ভুল সাব্যস্ত করত। এই প্রবণতার ভয়াবহতা উপলব্ধি করে উসমান (রা.) সূরাগুলো ধারাবাহিকভাবে সাজিয়ে আবূ বাকর (রা.)-এর সংকলন হতে আল কুরআনের অনুলিপি প্রস্তুত করেন। আরবী ভাষার অন্যান্য উপভাষায় তিলাওয়াতের সুযোগ রহিত করে কেবল কুরাইশী আরবী ভাষায় আল কুরআন সংকলন করা হল। প্রাথমিক যুগে শিক্ষার অনগ্রসরতার কারণে বিভিন্ন গ্রোত্রের লোকদের তিলাওয়াতের সুবিধার্থে নানা উপভাষায় কুরআন তিলাওয়াতের সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। পরবর্তীতে আরব গোত্রগুলো ইসলাম গ্রহণ করে এবং পরস্পরের কাছাকাছি আসায় ভাষার দূরত্ব দূর হয় এবং কুরাইশী ভাষা মানভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। তাই, কুরআন তিলাওয়াতের অভিন্নতার সুবিধার্থে অন্যান্য উপভাষায় তিলাওয়াতের সুযোগ রহিত করে কেবল কুরাইশী ভাষায় কুরআন সংকলন করা হয়।
জ: সাহীফা ও মুসহাফ:
সাহীহুল বুখারীর বর্ণনায় আবূ বাকর (রা.)-এর আমলের কুরআনের সংকলন বুঝাতে ‘সাহীফা’ ও উসমান (রা.)-এর আমলের সংকলন বুঝাতে ‘মুসহাফ' উল্লেখ করা হয়েছে।{‘মাসহাফ’, ‘মিসহাফ’ ও ‘মুসহাফ’- তিনটি শব্দের একই অর্থ: “দুটি মলাটের মাঝে একত্রিত পুস্তিকাসমূহ বা পৃষ্ঠাসমূহ [লুইস মা’লুফ, আল-মুনজিদ বৈরূত: ক্যাথলিক প্রেস ১৯০৮), ৪২৯], অর্থাৎ বাধাইকৃত বই বা পুস্তক। উসমান (রা.) কর্তৃক সংকলিত কুরআন বুঝাতে ‘মাসহাফ’ ও ‘মুসহাফ’-দুটি শব্দই ব্যবহার করা হয়। তবে সাহীহুল বুখারীতে ‘মুসহাফ’ শব্দটি উল্লেখ করা হয়েছে। এই অর্থে ‘মিসহাফ’ শব্দের প্রচলন দেখা যায় না। তিনটি শব্দের বহুবচনই হল ‘মাসাহিফ’। 'উসমান (রা.)-এর নির্দেশে সংকলিত কুরআনের কপিগুলোকে বুঝানোর জন্য ‘মাসাহিফে উসমানী’ প্রয়োগ করা হয়। }আনাস ইবনু মালিক (রা.) বলেন, “তাঁরা (সংকলকবৃন্দ) যখন সাহীফাগুলো (صحف) কপি করে মুসহাফ প্রস্তুত করলেন তখন উসমান (রা.) সাহীফাগুলো হাফসা (রা.)-এর কাছে ফেরত পাঠান এবং প্রতি প্রান্তে এক একটি মুসহাফ (مصحف) প্রেরণ করেন।” আরবী শব্দ ‘সাহীফা’-এর অর্থ হল ক্ষুদ্র গ্রন্থ বা পুস্তিকা। অপরদিকে ‘মুসহাফ’ এর অর্থ হল: দুই মলাটের মাঝে একত্রিত ও বাধাইকৃত পুস্তিকাসমূহ (সাহীফাসমূহ)। আল-বুখারীর(র.) শব্দ চয়ন হতে প্রতীয়মান হয় আবূ বাকর (রা.)-এর আমলে কুরআনের সূরাগুলো পুস্তিকা বা ছোট বই-এর আকারে লিপিবদ্ধ করে সেগুলোকে এক স্থানে একত্র করা হয়েছিল, তবে দুটি মলাটের মাঝে সেগুলোকে বাঁধাই করা হয়নি। পক্ষান্তরে উসমান (রা.)-এর আমলে পুরো কুরআনের কয়েকটি অনুলিপি তৈরি করে প্রত্যেকটিকে বইয়ের মত করে বাঁধাই করা হয়েছিল। এজন্য আবূ বাকর (রা.)-এর সংকলন বুঝাতে সাহীফাসমূহ এবং উসমান (রা.)-এর সংকলন বুঝাতে মুসহাফ শব্দ প্রয়োগ করা হয়েছে।
ঝঃ মুসহাফে উসমান সম্পর্কে আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদ(রা.)-এর ভূমিকাঃ
কুরআন সংকলনের ব্যাপারে ‘আবদুল্লাহ ইবনু মাস'উদ(রা.) উসমান (রা.)-এর বিরোধিতা করেছিলেন এমন কোন বিষয় বিশুদ্ধ সূত্রে বর্ণিত হয়নি। এই ধরনের কল্পিত কাহিনীর উৎস হল দুর্বল রিওয়ায়াত। অবশ্য সবক’টি দুর্বল রেওয়ায়াতে এটাও বলা হয়েছে যে, ইবনু মাসউদ(রা.) সাহাবায়ে কিরামের ঐকমত্যের সিদ্ধান্তের দিকে ফিরে আসেন। শুধু তাই নয় তিনি এ বিষয়ে সাধারণ্যে ঘোষণাও প্রদান করেন এবং লোকদেরকে ঐকমত্যের সিদ্ধান্ত মেনে নেয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, “আল্লাহ টেনেহিচড়ে 'ইলম উঠিয়ে নেবেন না, বরং তিনি ‘আলিমগণের তিরোধানের মাধ্যমে ‘ইলম উঠিয়ে নেবেন। উম্মতে মুহাম্মাদ ভ্রান্তির ওপর ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিষ্ঠিত থাকতে পারে না। তাঁরা যে বিষয়ে একমত হয়েছেন সত্য অবশ্যই সেখানে থাকবে।”[ফিতনা মাকতালি উসমান ইবনু অফফান, ১:৭৯ ]এই বক্তব্যটুকু ইবনু মাসউদ (রা.) লিখিতভাবে উসমান (রা.)-কে অবহিত করেন। ইবনু কাসীর(র.) ইবনু মাসউদের(রা.) ঐকমত্যে ফিরে আসার কথা উল্লেখ করেছেন।[আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, ৭:২২৮] আয-যাহাবী(র.) জোর দিয়ে বলেন, “শেষাবধি উসমান (রা.)-এর কর্মপদ্ধতিতে ইবনু মাসউদ (রা.) সন্তোষ প্রকাশ করেছেন এবং তাঁর আনুগত্য স্বীকার করেছেন।”[ আয-যাহাবী, সিয়ার.., ১:৩৪৯ ]
কুরআন সংকলন ও উসমান (রা.)-এর সাথে ইবনু মাসউদের সম্পর্ক বিষয়ে তাহা হুসাইন কিছু উদ্ভট কথা বলেছেন। তিনি প্রাচ্যবিদদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে এমন মন্তব্য করেছেন। কিছু লেখক আছেন যারা দুর্বল ও ইমামিয়া (শিয়া) বর্ণনার ওপর ভিত্তি করে সাহাবায়ে কিরামের পারস্পরিক সম্পর্কের ব্যাপারে মনগড়া মন্তব্য করেছেন।
ইবনু মাসউদ(রা.), যিনি মতভেদ ও ফিতনার ভয়ে এবং খালিফার আনুগত্য প্রদর্শনের জন্য মিনায় নামায কসর না করে পূর্ণরূপে আদায় করেছেন, তিনি মিম্বারে আরোহন করে খালীফার বিরুদ্ধে উস্কানি দিয়েছেন- এটা যুক্তিযুক্ত নয়।”[আবদুস সাত্তার শায়খ, আবদুল্লাহ ইবনু মাস'উদ, ৩৩৫ ]
কতিপয় ঐতিহাসিক ইবনু মাসউদের (রা.) নামে মিথ্যারোপ করেছেন এবং সাহাবায়ে কিরামের পারস্পরিক সম্পর্কের ব্যাপারে বিদ্বেষপূর্ণ বক্তব্য রেখেছেন। এইসব বর্ণনা সুস্থ বিবেকের কাছে অগ্রহণযোগ্য। কেউ কেউ মিথ্যামূলকভাবে বলেছেন, ইবনু মাসউদ (রা.), উসমান (রা.)-কে কাফির সাব্যস্ত করেছেন এবং খালীফাও তাকে প্রহারের নির্দেশ দিয়েছেন। এটি একটি চরম মিথ্যাচার; বর্ণনার পণ্ডিতগণ জানেন যে, ইবনু মাসউদ (রা.) খালীফাকে কাফির প্রতিপন্ন করেননি। বরং উসমান (রা.)-এর হাতে বাই'আত করার পর তিনি মাদীনা হতে কূফা গমন করেন। সেখানে পৌছে তিনি আল্লাহর প্রশংসা করে জনগণের উদ্দেশ্যে বললেন, “আমিরুল মু'মিনীন উমার ইবনুল খাত্তাব (রা.) মারা গেছেন, আমরা সাহাবায়ে কিরাম ঐকমত্যের ভিত্তিতে উসমান (রা.)-এর হাতে বাই'আত করেছি।"[ইবনু সাদ, আত্-তাবাকাত.., ৩:৬৩]
['আমীরুল মুমিনীন উসমান ইবনু আফফান রাদিআল্লাহু 'আনহু' - ড. যুবাইর মুহাম্মাদ এহসানুল হক; পৃষ্ঠা ২৬৯-২৮১]
Credit- Responce aid anti Islam
কোন মন্তব্য নেই