হিন্দু ধর্মগ্রন্থে গোবধ ও গোমাংস
হিন্দু ধর্মগ্রন্থে গোবধ ও গোমাংস
ভোজনের প্রমাণ ||
১|• শ্রাদ্ধে অতিথিদের গোমাংস ভক্ষন করালে পূর্বপুরুষ ১ বছর স্বর্গসুখ পেতে পারে, এই উপদেশ যুধিষ্ঠিরের প্রতি পিতামহ ভীষ্মের, (মহাভারত, অনুশাসন পর্ব, অধ্যায় ৮৮; কালিপ্রসন্ন সিংহ)।
৩|• রাম গরুর মাংসের সঙ্গে মদ খেতে ভালবাসত। বনবাস-প্রাক্কালে মায়ের কাছে রামের আক্ষেপ, সে ১৪ বছর গোমাংস খেতে ও সোমরস পান করতে পারবে না এবং সোনার খাটে ঘুমাতে পারবে না; "রাম গোমাংস ভক্ষণ করতেন।" (বাল্মীকী রামায়ণ, আদিকাণ্ড, অযোধ্যাকাণ্ড)।
রাম, লক্ষ্মণ, সীতা বনবাসে যাবার পথে ভরদ্বাজমুণির আশ্রমে বৃষমাংস, মধুপর্ক, ফলমূল খেয়েছিল, (বাল্মীকী রামায়ণ ২/৫৪)।
৪|• গোহত্যা এবং গোমাংস খাওয়ার বিধান রয়েছে শতপথ ব্রাহ্মণ ১১১/১/২১।
৫|• ঋগ্বেদে বৈদিকআর্যদের গোমাংস খাওয়ার বহু উল্লেখের থেকে---
"ইন্দ্র বলল তাদের খাওয়ার জন্য ২০টি ষাঁড় রান্না করা হয়েছে (ঋগ্বেদ ১০/৮৬/১৪ (অনুবাদ রমেশ চন্দ্র )।
গোমাংস ইন্দ্রের অতিপ্রিয় ছিল।
ঋগ্বেদে অগ্নির উদ্দেশ্যে ঘোড়া, বলদ, ষাঁড়, দুগ্ধহীন গাই, মেষ বলির উল্লেখ আছে। গরু বা ষাঁড়গুলিকে বৈদিকআর্যরা তরোয়াল বা কুড়ুল দিয়ে হত্যা করতো।
একটি বেঁটে ষাঁড় বিষ্ণুর উদ্দেশ্যে, একটি চিত্কপালী শিংওয়ালা গরু ইন্দ্রের উদ্দেশ্যে, একটি কালো গরু পুষনের উদ্দেশ্যে, একটি লাল গরু রুদ্রের উদ্দেশ্যে বলি দেওয়া হতো।
ঋগ্বেদ সংহিতায় "বিবাহসূক্ত"-এ কন্যার বিয়েতে সমাগত অতিথিদের গোমাংস পরিবেষনের জন্য অজস্র গরু বলির বিধান আছে, (ঋগ্বেদ সংহিতা ১০/৮৫/১৩ অনুবাদ রমেশ চন্দ্র)।
৬|• তৈত্তিরীয়ব্রাহ্মণে "পঞ্চশারদীয়-সেবা" নামক ভোজন অনুষ্ঠানের প্রধান বৈশিষ্ট্য, ৫বছরের কম বয়সী ১৭টি বাছুরের মাংসে অতিথি আপ্যায়ন।
৭|• বিষ্ণুপুরাণও গোমাংস ভোজনকে সমর্থন করেছে। শ্রাদ্ধের দিনে ব্রাহ্মণদের মৎস্যদানে ২মাস, শশক মাংস দানে ৩মাস, ছাগ মাংস দানে ৬মাস, মেষ মাংস দানে ১০মাস এবং গোমাংস দানে ১১মাস পিতৃগণের আত্মা পরিতৃপ্ত থাকে, (বিষ্ণুপুরাণ ৩/১৬, ঔর্ব্য মুনির বচন (নবভারত পাবলিকেশন্স)।
৮|• অষ্টাধ্যায়ী: পাণিনি চতুর্থ-ষষ্ঠ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মানুষ। তিনি সংস্কৃত ব্যাকরণবিদ। তিনি রচনা করেন অষ্টাধ্যায়ী নামক ব্যাকরণ গ্রন্থ। অষ্টাধ্যায়ীতে একটি সূত্র – "দাশগোঘ্নৌ সম্প্রদানে।" শ্রীশচন্দ্র বসুর অনূদিত অষ্টাধ্যায়ী গ্রন্থে এই যা বলা আছে তা---
"এখান হতে যা জানা যাচ্ছে তা হলো, গোহত্যাকারীকে গোঘ্ন বলা হয় না বরং যার (অতিথির) আগমনে গরু হত্যা করা হয় , তাকেই গোঘ্ন বলা হয়।
৯|• গোপালকেরা মাংসের জন্য ছাপ দেওয়া গরুর মাংস কাঁচা অথবা শুকিয়ে বিক্রি করতে পারে, (চাণক্য অর্থশাস্ত্র ২/২৯/১২৯)।
১০|• চরকসংহিতা গোমাংসের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা ও পুষ্টিগুণের কথা বলেছে এবং গোমাংস খাওয়া সমর্থন করেছে। গোমাংস বাত, নাক ফোলা, জ্বর, শুকনো কাশি, অত্যাগ্নি (অতিরিক্ত ক্ষুধা বা গরম), কৃশতা প্রভৃতি অসুখের প্রতিকারে বিশেষ উপকারী (চরকসংহিতা ১/২৭/৭৯)।
১১|• সুশ্রুতরও একই সুর, গোমাংস পবিত্র এবং ঠান্ডা; হাঁপানি, সর্দিকাশি, দীর্ঘস্থায়ী জ্বর, অতি ক্ষুধা, বায়ু বিভ্রাটের নিরাময় করে, (সুশ্রুতসংহিতা ১/৪৬/৪৭)।
১২|• অর্থশাস্ত্রে: কৌটিল্য বা চাণক্যে:
কৌটিল্যের সময়ে গোমাংস ভক্ষণ সুপ্রচলিত ছিল। মাংস বিক্রি করতে হতো হাড় ছাড়া, কোন বিক্রেতা যদি মাংসে হাড় দিত তবে সেই হাড়ের সমপরিমাণ মাংস দিয়ে পূরণ করে দিতে হতো। অর্থশাস্ত্রে উল্লেখিত আছে---
১৩|• মাংসবিক্রয়বিধিঃ---
"মৃগ-পশূনামনস্থি মাংসং সদ্যোহতং বিক্রীণীরন্। অস্থিমতঃ প্রতিপাতং দদ্যুঃ। তুলাহীনে হীনাষ্টগুণম্।
( সর্বথা অবধ্যাঃ প্রাণিনঃ, তদ্বধে দণ্ড শ্চ-) বৎসো বৃষো ধেনুশ্চৈষামবধ্যাঃ। ঘ্নতঃ পশ্চাশৎকো দণ্ডঃ। ক্লিষ্টঘাতং ঘাতয়শ্চ।" ২/২৬/৩
বঙ্গানুবাদঃ (মাংস বিক্রেতা) মৃগ ও পশুদের অস্থিবিহীন সদ্যোহত (নতুন বা শুদ্ধ) মাংস হাড় ছাড়া তাজা মাংস (বাজারে) বিক্রয় করবে। বিক্রীত মাংস যদি অস্থিযুক্ত হয়, তাহলে বিক্রেতাকে প্রতিপাত অর্থাৎ হাড়ের সমান ওজনের মাংস হাড়ের বদলে পূরণ করে দিতে হবে। মাংস যদি কাউকে ওজনে কম দেওয়া হয় (তুলাহীনে), তাহলে বিক্রেতা যে পরিমাণ মাংস কম দিয়েছে, তার আটগুণ বেশি দণ্ড দিতে বাধ্য থাকবে। ( অনুবাদ: মানবেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়)
.
১৪|• বিশেষ_গোমাংস ---
সূনামহিষ নামে একরকমের মহিষ মাংসের জন্য ব্যবহৃত হতো বলে অর্থশাস্ত্র হতে জানা যায় –
"বৎস্যা বৎসতরা দম্যা বহিনী বৃষা উক্ষাণশ্চ পুংগবাঃ। যুগবাহন-শকটবহা বৃষভাঃ সূনামহিষাঃ পৃষ্ঠস্কন্ধ-বাহিনশ্চ মহিষাঃ।" ২/২৯/৩
বঙ্গানুবাদঃ বৎস ( দুধ পান করে যে বাছুর), বৎসতর ( যে বাছুর স্তন্যপান পরিত্যাগ করেছে , অর্থাৎ কিছু বড় হয়েছে), দম্য (দমনযোগ্য, ক্ষেত্রে কৃষিকর্ম শেখানোর যোগ্য), বহিন (বোঝা বহনক্ষম ষাঁড়), বৃষ (বীর্যসেচনকারী ষাঁড়) এবং উক্ষা (হাল চালানোর যোগ্য)- এই ছয় রকমের পুংগব (পুরুষ গরু) হতে পারে। যুগবহনকারী ও শকটবহকারী, বৃষভ ( বীর্য সেচনকারী) , সূনামহিষ (শুধুমাত্র মাংসের জন্য উপযোগী মহিষ) , পৃষ্ঠ ও স্কন্ধবাহী এই চার রকমের মহিষ হতে পারে। … ( অনুবাদক- মানবেন্দু বন্দোপাধ্যায়)
.
কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র অনুসারে মৃত গরুর চামড়া ব্যবহার করা হতো –--
১৫|• করপ্রতিকরঃ--- "জরদগু-ধেনু-গর্ভিণী-পষ্ঠোহী-বৎসতরীণাং সমবিভাগং রূপশতমেকঃ পালয়েৎ। ঘৃতস্যাষ্টৌ বারকান্, পণিকং পুচ্ছম্ , অঙ্কচর্ম চ বার্ষিকং দদ্যাদিতি করপ্রতিকরঃ।' ২/২৯/২
বঙ্গানুবাদঃ জরদগু ( অর্থাৎ জরদগবী, বৃদ্ধ গাই), ধেনু ( দুধ দেয় যে গাই), গর্ভিণী গাভী, পষ্টোহী ( প্রথম গর্ভবতী গাভী বা বৃষ-গবেষণী অর্থাৎ যে গাভী কোনও বৃষের সাথে সঙ্গত হতে চায়) ও বৎসতরী ( যে গাভী অল্পদিন আগে স্তন্যপান ত্যাগ করেছে)- এই পাঁচ জাতীয় গাভীকে সমবিভাগ করে ( অর্থাৎ প্রত্যেক প্রকার গাভী কুড়িটি করে নিয়ে ) রূপশত গাভী ( অর্থাৎ মিলিতভাবে জরদগু প্রভৃতি একশত গাভী) একজন গোপালক পালন করবে। এই পালক প্রতি বৎসর আট বরাক (=৮৪ কুডুব) ঘি, পুচ্ছ গণনায় দেয় ১ পণ কর ( অর্থাৎ প্রত্যেক পশুর জন্য ১ পণ কর; অতএব ১০০ টি পশুর জন্য ১০০ পণ কর) এবং অঙ্কচর্ম অর্থাৎ পশু মৃত হলে তার চামড়া রাজমুদ্রার দ্বারা চিহ্নিত করে গোহধ্যক্ষকে দেবে। এই প্রকার গোরক্ষণ এবং গবাদি পশু থেকে উৎপন্ন দ্রব্য মালিককে দানকরা-রূপ ব্যাপারকে করপ্রতিকর বলা হয়। ( অনুবাদক- মানবেন্দু বন্দোপাধ্যায়)
.
১৬|• চামড়া_ব্যবহার ---
মৃত গরু, মহিষ প্রভৃতির চামড়া, লোম, মূত্রাশয় ,পিত্ত, অন্ত্র, দাঁত, খুর, শিং, অস্থি ইত্যাদি ব্যবহারের জন্য সংগ্রহ করা হতো। অর্থশাস্ত্রে---
"কারণমৃতস্যাঙ্কচর্ম গো-মহিষস্য, কর্ণলক্ষণম্ অজাবিকানাং পুচ্ছমঙ্কচর্ম চাশ্বখরোষ্ট্রাণাং, বালচর্মবস্তিপিত্তস্নায়ুদন্তখুরশৃঙ্গস্থীনিচাহরেয়ুঃ।" ২/২৯/৬
বঙ্গানুবাদঃ গোপালক (ব্যাধি, জরা প্রভৃতি স্বাভাবিক) – কারণে মৃত গরু ও মহিষের চামড়া রাজমুদ্রার দ্বারা চিহ্নিত করে, ছাগল ও মেষের কান ঐ রকম মুদ্রার দ্বারা চিহ্নিত করে গোহধ্যক্ষকে (যাতে গোহধ্যক্ষের প্রত্যয় হয় যে, স্বাভাবিকভাবেই ঐ সব পশুর মৃত্যু হয়েছে); (গোপালক) ঐ সব মৃত পশুর লোম, চর্ম, বস্তু (মূত্রাশয়), পিত্ত, স্নায়ু (অন্ত্র), দাঁত, খুর, শিং এবং অস্থি (হাড়) আহরণ করে আনবে (এবং সম্ভবতঃ এই জিনিসগুলি রাজকীয় ক্যুপগৃহে জমা দিতে হবে)। ( অনুবাদক- মানবেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় )
.
এর পরেও বলা আছে মৃত পশুর মাংস বিক্রি করা যাবে।---
১৭|• পূর্বানুবৃত্তিঃ---
"মাংসম্ আমম্ আর্দ্রং শুষ্কং বা বিক্রীণীয়ুঃ …" ২/২৯/৭
বঙ্গানুবাদঃ ( মৃত পশুর) মাংস অপক্ক, আর্দ্র অবস্থায় বা শুকিয়ে নিয়ে বিক্রয় করতে হবে। ( অনুবাদক- মানবেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় )
.
.
১৮|• শ্রাদ্ধে গোদান হলো গোমাংস দানের অপভ্রংশ রূপ।
.
আরও উদাহরণ আছে বৈদিক ও পৌরাণিক সাহিত্যে।
প্রশ্ন,
বেদসংহিতা, ব্রাহ্মণগ্রন্থ, পুরাণ, মনুসংহিতা, মহাভারত, রামায়ণ হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থ। হিন্দুরা কি এই ধর্মগ্রন্থগুলো মানে না?
.
অতএব, গোমাংস হিন্দুদের বৈধ।
______________________________
[শমীন্দ্রঘোষ পুনঃপ্রকাশ]
{ব্রাদার রাহুল হোসেন রুহুল আমিন}
পশ্চিমবঙ্গ-ভারত)
কোন মন্তব্য নেই
নতুন মন্তব্যগুলি মঞ্জুরিপ্রাপ্ত নয়৷